Thursday, September 27, 2012

বৃষ্টি ভেজা চোখ

আবুল কাইয়ূম আহম্মদ : আব্বুর বন্ধু সাইকি বিশেষজ্ঞ ডাঃ মনোয়ার পাশা আজ আমাদের  বাসায় এসেছেন। আংকেলের সাথে কথাবার্তার সময় আব্বু দেয়ালে টাঙ্গানো স্থির  শান্ত মায়াবী ফ্রেমে বাঁধানো ফটোটি দেখিয়ে বললেন, এটা আমার মৃত মেয়ে বৃষ্টির ছবিসে তিন বছর পূর্বে ঐ দিনে নৌকা-ডুবিতে মারা গেছেএ কথায় আব্বুর গলা একটুও কাঁপলনাবুক চিরে বের হলোনা কোন দীর্ঘশ্বাসনিজের কন্ঠস্বরে আব্বু নিজেই চমকে উঠেন। আংকেল বৃষ্টি সম্পর্কে সামান্যই জানতেনআজ বৃষ্টির তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকীবিস্তারিত জানতেই তিনি সময় নিয়ে এসেছেনআব্বু আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,- ডক্টর পাশা আমার ছেলে নির্ঝরই সব বলতে পারবে? তুমি তো তিন বছর ধরে আসবে আসবে বলে আসছো নাতুমি সাইকি বিশেষজ্ঞ; সময়ও তো নির্ধারণ করা তোমার জন্য বিরাট ব্যাপার-ওই বলে আব্বু ভিতরের রুমে চলে
গেলেন
আমি বৃষ্টি সম্পর্কে বলা শুরু করলাম :-

আমি তখন এম.এ শেষ পর্ব পরীক্ষা দিয়েছিওই অবসরে ক্যাসেট প্লেয়ারে গান শোনা, বই পড়া ছিল আমার নিত্যদিনের কাজএকদিন প্রচন্ড বৃষ্টি হচ্ছে, তখন সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে  আব্বু অফিস থেকে ফেরেনিআম্মু রান্না ঘরে কাজ করছেনআমি আমার পড়ার টেবিলে বসে ভিক্টর হুগোর  বই পড়ছি আর রবীন্দ্র সংগীত শুনছি

‘‘পাগলা হাওয়ার বাদল-দিনে
পাগল আমার মন জেগে ওঠে

হঠা আমার পিছন দিকে একটা নরম হাতের স্পর্শ অনুভব করিসে আর কেউ নয়, আমার ছোটবোন বৃষ্টি বোনটি পড়ে কাস টুতেভারি মায়াবি ছোট গোলগাল মুখতার চেহারা কথা-বার্তায় স্বতস্ফর্তভাবেই যে কোন মানুষকে অনুপ্রাণিত করতওই বয়সে সে সবার মন জয় করেছিলও যখন আধো আধো স্বরে দাদা দাদা বলে ডাকে-তখন মনে হয় এমন মধুর ডাক পৃথিবীতে আর কী আছে? সব কাজ ফেলে ওকে কোলে তোলে নেই, আদর করিও যখন বায়না ধরে ‘‘দাদা’’ আমাকে একটা পুতুল এনে দাও নাআমি আর থাকতে পারি নাদৌড়ে গিয়ে দোকান থেকে বেছে বেছে সবচেয়ে সুন্দর পুতুলটা ওর জন্য কিনে আনতামআব্বু যখন বাড়িতে থাকতেন, তখনও আব্বুর কোলে বসে নানা প্রশ্ন করে আব্বুকে একেবারে অতিষ্ঠ করে তুলতোওর দার্শনিক কথায় আমরা অবাক হতামও একবার মুখে যা বলতো, তাই ঘটে যেতওর জন্য সবারই কেমন যেন একটা আলদা দরদ ছিলএকদিন ছুটি হবে, অনেক দূরে যাব, নীল আকাশের সবুজ ঘাসে খুশিতে হারাব আগুন জলেরে, নিভানোর মানুষ নাইএ ধরনের গান গুণ গুণ করে গাইতওর গানের সুর যে কোন মানুষকে ভাবিয়ে দিতঢাকায় কয়েকটা অনুষ্ঠানে গান গেয়েছিল, কিন্তু মানুষের সীমাহীন যন্ত্রনায় আম্মু কোন অনুষ্ঠানে আর বৃষ্টিকে অংশগ্রহণ করতে দেয়নি

আমাদের নানা বাড়ি হাওর এলাকায়বৃষ্টি কখনো হাওর দেখেনিবর্ষায় হাওর সাগরের মতো রূপ ধারণ করে এটা বৃষ্টি বিশ্বাস করে নাতার কথা হল না দেখে কোনো কিছু বিশ্বাস করতে নেইবাবাকে  বারবার আবদার করেছে নানা বাড়ী যেয়ে সে হাওর দেখবেঅফিসের নানান কাজে ব্যস্ত থাকায় বাবা এতদিন যেতে  পারিনিএবার যাবেনআষাঢ়ের ৩০ তারিখ যাবার দিন নির্ধারণ করা হয়েছবৃষ্টির সে যে কী আনন্দ! কবে সেই কাঙ্খিত ৩০ তারিখ আসবে? সেই কাঙ্খিত ৩০ এলআমাদের এক ছোট্ট খালা আছেতিনি একটা বে-সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষকখালার একটা মেয়ে ৫ম শ্রেণীতে পড়তোবৃষ্টির চেয়েও সে তিন বছরের বড়তার নাম ছিল মন্টিকিন্তু আমি ডাকতাম বকবকিকারণ ও  যখন কথা বলতো তখন আর তামতো নাছোট খালা ছিল ভীষণ হিংসুটেখালার স্বভাব পেয়েছিল মন্টিআমাদের বাসায় বেড়াতে এলেই ও বৃষ্টিকে বিনা কারণে মারতোবৃষ্টি কাউকে কখনো বিচারও দিতো নাআমি যখন মাঝে মাঝে দেখে ফেলতাম-তখন মন্টিকে ভীষন ধমক দিতামমন্টি তা বাড়িয়ে খালামনিকে বলতোতাই খালামনি আমাকে পছন্দ করতেন না
 আমরা যাত্রা করলাম মোহনগঞ্জের উদ্দেশ্যেযাত্রা পথে বৃষ্টির নানান প্রশ্ন? এ জায়গাটার নাম কী? জায়গাটার নাম এমন হল কেন? অন্যরকম হলনা কেন? ইত্যাদি ইত্যাদিহাওর আর কত দূর? হাওর এখনো আসছে না কেন?
নেত্রকোণা শহর দেখে বৃষ্টি মুগ্ধ হতে পারেনিঢাকার সাথে নেত্রকোণার কোন ভাবেই মেলে নাতারপরও নেত্রকোণা শহর খোলামেলাপ্রচুর গাছপালা আছে এখানে প্রাণ খুলে শ্বাস নেওয়া যায়ওই দিকটাই বৃষ্টির পছন্দ হয়েছেতার ভাব দেখে তাই মনে হল
সাপমারা খালের শেষ মোহনায় একটু এগোতেই ডিঙ্গাউতার ওপারের গ্রামগুলো পানির ওপরে ভেসে উঠলোগ্রামগুলো যেন টিক ছবির মতোবৃষ্টি বলেই ফেলল- আম্বু  তাহলে এটাই  হাওর ! বৃষ্টি আরেক ভাবনার জগতে পড়ে যায়দূর থেকে ইঞ্জিল চালিত নৌকার শব্দ ভেসে আসছেএদিক ও দিক তাকালেই দেখা যায় ছোট ছোট নৌকাবৃষ্টি আবারও বলল, আম্মু  ছোট ছোট নৌকায় মানুষেরা কী করছে? ওদের নৌকা ডুবছেনা কেন? গ্রামগুলো পানির ওপরে ভাসছে কেন? ডিঙ্গাউতা নামটি কেমন করে হল? আর বিশাল হাওর দেখে তো বৃষ্টি আবেগে আপ্লুত হয়ে গেলআমরা নানা  বাড়ি এসে যখন পৌছেছি, তখন চারদিক থেকে মানুষ  এক নজর বৃষ্টিকে দেখার জন্য ভিড় করছে
ছোট ছোট ছেলে মেয়ের বাজার জমে গেলকোনটা ল্যাংটা, কোনটার হাফ-প্যান্ট ছেঁড়া, কোনটার ফ্রক ময়লা, নোংরা, কোনটার নাকে ছিদ্র পথে সিঙ্গাইল বেরিয়ে আছে, কোনটার চোখের কোনে ময়লাকোনটা খিল খিল করে হাসে, পরস্পরের মধ্যে দুষ্টুমিও করেএগুলো দেখে বৃষ্টি একেবারে নীরব হয়ে গেলখালামনি ওদের কড়া ভাষায় শাসিয়ে দিলমন্টি অকথ্য ভাষায় গালি গালাজ করতে থাকলোআব্বু তাদের ধমক দিয়ে থামিয়ে দিল

মা রাগ করে এক পর্যায়ে বলল- আমারা অনেক দূর থেকে এসেছিআমরা কান্ত, আপনারা এখন চলে যানআমরাই আপনাদের সবার বাড়িতে বেড়াববৃষ্টি মার কথা টেনে নিয়ে বলল কারো বাড়িতে কেউ আসলে তাকে এভাবে তাড়িয়ে দিতে নেইএ কথা শোনে সবাই কিছুনের জন্য  নির্বাক দাঁড়িয়ে বৃষ্টিকে দেখতে লাগলএমন সময মামা ডাকলেন- ওই মর্জিনা শরবত নিয়ে আয়সঙ্গে সঙ্গে দৌড়ে একটা মেয়ে ঝগ ভড়ে শরবত নিয়ে এলতার চেহারা দেখে মনে হলনা সে কাজের মেয়েবয়স ১৭-১৮ হবে

হাওরের দশবারোটি বাড়িআবার কখনো পনের বিশটা বাড়ি নিয়ে একটা পাড়া গঠিত হয়পাড়াগুলোকে আঁটি বলেযেমন পশ্চিম আটি, পূর্ব আঁটিবর্ষকালে প্রতিটা আঁটিই পানি দ্বারা বেষ্টিত থাকেআমরা পরের দিন ডিঙ্গি নৌকা নিয়ে আঁটি দেখতে বের হইসঙ্গে তো মর্জিনা আছেইমর্জিনায় বৃষ্টিকে দেখিয়ে দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছেআমরা যখন বের হই তখন ছোট বড় ছেলেমেয়ের দল এসে আমাদের সঙ্গে যোগ দেওয়ায় দলটা আরো বৃদ্ধি পেতে থাকলকারো ঘরেই কোন ভাল খাট নেই, বিছানা নেই, কোন সোফা নেই, কোনো ফর্নিচার নেইবাড়ির বেড়া অনেকটা ভাঙ্গাবোড়ার ফাঁক দিয়ে হাওরের পানি দেখা যায়কেউ ভাত খাচ্ছে, শোকনা মাছের গুড়া, ছেপা শুটকি মিশিয়ে, খুব কম বাড়িতেই দেখা গেল মাছ দিয়ে ভাত খেতেএকটা বিষয় বৃষ্টি বুঝতে পারে এদের বাহিরটা যত নোংরা হোক, ভেতরটা বড় পরিস্কারকত কষ্ট তাদের! তারপরও ওরা মনের আনন্দে গান গায়মর্জিনা হঠা একটা মহিলাকে পরিচয় করিয়ে বলে- বৃষ্টি আপু ও আমার সইভাল গান গাইতে পারেসই বৃষ্টিকে একটা গান শোনাওআর ওদিকে একটা বয়স্ক মহিলা আমাদের একটা শীতপাটি এনে দিলআমরা সবাই বসলামতিনি শুরু করলেন সোনার ময়না পাখিরে আমারওই গান শুনেতো বৃষ্টি বিশ্বাসই করতে পারছে নাএত সুন্দুর স্বরে হাওরে কেউ গান গাইতে পারে? গান শেষ হলে এই প্রথম বৃষ্টির মুখে শুনলাম আরেকটা গান গাইবেন? উনি বৃষ্টিকে আপুবলে আবার গাইলেন?--- ‘মনের দুঃখ কইতাম রে বন্ধু, রাইখাছি অন্তরে
গানটা শেষ হওয়া মাত্রই খালামনি বলে উঠলেন- আমার মেয়ে মন্টি ভালো গান গাইতে পারেআপনারা শুনবেন! সবাই বলল- হ্যা

মন্টি শুরু করল- মন মেতেছে মন ময়ূরীর মন ময়ূরীর কী খেলা, নাম না জানা ফুল ফুঠানোর এই বেলা’---
বেসুরে গান গাওয়ায় কেউ হাততালি না দেওয়ায় ছোট খালা এক পর্যায়ে বলে ফেলল- ওই ছোটলোকের বাচ্চারা তোরা হাত তালি দিলে না কেন? তোরা কি বোঝবে ওই গানের অর্থ? তোরা হলি ভাইট্যা গাবর, তোরা সোনার ময়না পাখিই বুঝবেএ কথা শুনে মর্জিনার সই তীব্র প্রতিবাদ করে বলেন- ছোট ফুফু আপনিও কিন্তু ভাইট্যাএক পর্যায়ে ভীষণ ঝগড়া শুরু হলযতই আপন হোক নিজের জন্ম ভূমিকে কেউ কটা করে কথা বললে কেউ সহ্য করতে পারে নাবৃষ্টি এক পর্যায়ে বলে উঠে-খালামনি তুমি কিন্তু দুটো গানকেই অবমূল্যায়ন করেছতুমি একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিকসুধীন দাস গুপ্ত এবং হাসন রাজাকে এভাবে অপমান করা তোমার ঠিক হয়নিতুমি মা চাও! নয়তো তোমার বিপদ ঘটবেখালামিন উচ্চস্বরে হেসে হেসে আবার বলেন- আমার বিপদ ঘটবে !  কী বলিস বৃষ্টি? এই বলে খালা  নানা বাড়ি চলে যায়
মর্জিনার সই বৃষ্টিকে এবার বললেন- শিল্লুকশুনবে বৃষ্টি আপুশিল্লুক কি? তিনি বলেন এক প দুই চারটা ছড়ার লাইন বলবে, অন্য প সেই ছড়ার অর্থ বলে দেবে, এটাই শিল্লুকবৃষ্টি মহা আনন্দে বলে উঠে বলুন বলুনমর্জিনা সই বলেন ঘর আছে দোয়ার নাই, মানুষ আছে রাও নাই, মর্জিনা বলে এটা কবরএবার মর্জিনা বলল- জঙ্গল থাইকা আইল বুড়ি, চোখ তার আঠার কুড়িতিনি উত্তর দিলেন-আনারসপাশে বসে আম্মু খুব উপভোগ করছিলএ ভাবে অনেকন শিল্লুক চলছিল
বাড়িতে এসে বৃষ্টির কত যে প্রশ্ন?ওই ছেলে মেয়েগুলোর কাপড় নেই কেন? ওদের সবাইকে তো মাছ মারতে দেখেছি, তবে কেন ওরা মাছ খায় না? ওদের অনেকের ঘর ভাঙ্গা কেন? খালার এমন ব্যবহারে পুরো গ্রামের মানুষের হৃদয়ে আঘাত করলসব মানুষ খালাকে ছিঃ ছিঃ দিতে থাকল

একদিন কাক-ডাকা ভোরে ছোট খালার চেঁচামেচিতে ঘুম ভেঙ্গে যায়তিনি হাউমাউ করে কাঁদেতে লাগলেনআম্মু বলেন- ছোট তোর কী হয়েছে- বলতোখালা মনি উত্তেজিত স্বরে বলেন তোমাকে বলে কিছু লাভ হবে না, তুমি আমার সামনে থেকে চলে যাওমামা এক পর্যায়ে খালামনি কে বলেন- তোর কি হয়েছে বল?  খালা এবার চোখের জল মুছতে মুছতে বলেন- আমার সব গয়না চুরি হয়েছেমামা উত্তেজিত হয়ে বলেন- কি করে হলখালামনি তার ল্যাগেজ এনে দেখালো ওই দেখ কিভাবে ভেঙ্গে স্বর্ণগুলো নিয়ে গেছে? চোর  ঘরেই আছেআমার একশতভাগ বিশ্বাস মর্জিনাই গয়নাগুলো নিয়েছেমামা কিছুতেই বিশ্বাস করতে চান নাখালামনির গলর স্বর ক্রমেই বাড়তে থাকলোতিনি গলা ফাটিয়ে বলেন- মর্জিনা কোথায় গেছে খুঁজে বের করুনযেহেতু মর্জিনা বাড়িতে নেই, তাই মর্জিনাই আমার গয়নাগুলো নিয়ে পালিয়েছেমামা এবার খালামনিকে উদ্দেশ্য করে বলেন, তুই বাড়ীতে এলেই  সমস্যার সৃষ্টি করিস,  মর্জিনা কাজের মেয়ে হতে পারে, তবে ও চোর নয়, তুই জানিস না, ওর কাছে এখনো দুই ল টাকা  জমা আছেকারন এই হাওর এলাকায় কখন টাকার দরকার হয় কেউ জানেনাব্যাংকে যেয়ে টাকা তোলে বাড়ী আসতে আসতে রাত হয়ে যায়ও এমন বিশ্বস্থ যে, যে ভাবে টাকার নোটগুলো জমা রাখা হয়, সেই ভাবে ফেরত পাওয়া যায়

এরই মাধ্যে দেখা গেল মর্জিনা তার স্বামীকে মামার কাছে ধরে নিয়ে এসে বলে- ওই চোরটা ছোট খালার স্বর্ণ চুরি করেছেওকে বাধুনতারপর মামার হাতে গয়না তুলে দেনমামা খালামনিকে গয়না বুঝিয়ে দিয়ে বলেন এবার কান্না বন্ধ কর ছোট খালামনি কান্না বন্ধ না করে হাতে লাঠি নিয়ে শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে মর্জিনা ও তার স্বামীকে পেটাতে থাকেমামা অনেক চেষ্টা করেও ফেরাতে পারছে নাওদিকে অনেক মানুষের ভীর জমে গেছেবৃষ্টি হঠা করে খালামনির পা ধরে অশ্রজলে বলে- খালামনি ওদের আর মেরো নাওরা যে মরে যাবেতখন একটা আশ্চর্য ঘটনা ঘটল কোথায় থেকে যেন গোখরা সাপ এসে খালামনিকে ঘিরে ধরলখালামনি তো চিকার! সাপ! সাপ! ভয়ে খালামনি কাঁপতে লাগল এবং হাত থেকে লাঠি পড়ে গেলমামা সেই লাঠি তুলে নিলসঙ্গে সঙ্গে চল্লিশ পঞ্চাশ জন লোক দেশিয় অস্ত্রসহ সাপগুলোকে মারবার জন্য মামার সঙ্গে যোগ দিলবৃষ্টি সাপগুলোকে মারতে নিষেধ করলতারপরও যখন নিষেধ মানছে না তখন বৃষ্টি সাপগুলোকে ধরে পাহারা দিতে থাকেচারদিকে চিকার- বৃষ্টিকে সাপগুলো  ছোবল দিচ্ছেআম্মু কোথায় থেকে যেন দৌড়ে এসে বৃষ্টিকে কোলে তোলে নিল এবং কোন সাপ দেখতে না পেয়ে আমাকে বলল- তুইও মিথ্যা শিখে ফেলছিস!

মামা বলল- সত্যি সাপ ছিলসবাইকে জিজ্ঞাসা কর তাছাড়া নির্জরও তো দেখেছে
আম্মু বৃষ্টিকে চুমু দিয়ে আদর করতে করতে বুকের সাথে মিশিয়ে বলেন- মারে তুই এসব কী শুরু করছিসতোকে নিয়ে আমার ভয়টা দিন দিনই বাড়ছেআব্বু তখন কোথায় যেন চলে গিয়েছিলহঠা আব্বু এসে বলেন কী যেন ঘটেছেআম্মু রাগের স্বরে বলেন- তুমি ত মেয়ের খবর রাখ না? নৌকা ঠিক কর, আমরা আজই ঢাকা চলে যাবমামা সহ আশে পাশের সবাই মাকে বুঝিয়ে থামালওদিকে খালামনির  অমানবিক নির্যাতনে মর্জিনা ও তার স্বামীর অবস্থা সংকট জনকস্থানীয় এক ডাক্তারকে নিয়ে আসা হলতিনি কিছু ঔষধপত্র লিখে দিলেন এবং রোগীদের মোহনগঞ্জ কিংবা নেত্রকোণা দ্রুত পাঠাতে নির্দেশ দিলেনআব্বু, মামা নৌকা ভাড়া করে রোগীদের নিয়ে মোহনগঞ্জ চলে যায়
মনটা আমার ভাল যাচ্ছিলনা, তাই  নানাবাড়ি থেকে একটু দূরে একটা নদীর ধারে  পাকা বেদির উপর বসে এসব ঘটনা নিয়ে ভাবছিদূর থেকে বিশাল বিশাল ঢেউ এসে বেদির ওপর আঁচড়ে  পড়ছেএমন সময় অনেক গুলো বেদের বহর দেখতে পেলামনৌকাগুলো দেখে মনটা কেমন জানি ধক করে উঠল
তিনদিন পর মর্জিনা  এবং তার স্বামীকে সুস্থ করে মামা নিয়ে আসলেনমর্জিনা আর নানার বাড়ি থাকলো নাযাবার সময় মর্জিনা কি যে কান্না তা প্রকাশ করার মত নয় ! আম্মু মামার শত অনুরোধ স্বত্তেও সে নিজ বাড়িত চলে যায়  আব্বা ঢাকা চলে গেলেনআম্মুকে মামা একটা চিঠি দিলেন চিঠিতে লেখা তুমি বৃষ্টি এবং নির্ঝরকে কাছে কাছে রাখবেআমি তিনদিনের ভেতর আসছিতুমি কোন চিন্তা করবে না

পরের দিন বেদের দল মামার বাড়ি সাপ খেলা দেখাবেপ্রায় পুরো গ্রামের মানুষ মামার বাড়ি দখল করে নিয়েছেএরই মাঝে খালামনিকে কয়েকজন বেদের সঙ্গে ফিসফিসানো কথা বলতে দেখলামসাপের খেলা শুরু হলগ্রামের সবার আবদার তারা বৃষ্টির  নাচ ও গান শুনবেমন্টির গান শুনবে না কারণ মন্টি বেসুরে গান গায়আম্মু কিছুতেই বৃষ্টিকে গান গাইতে দেবে নাগ্রামের সবার কথায় আম্মু রাজি হলেনবৃষ্টি নাচ শুরু করল-   
বাবু সেলাম বারে বার
আমার নামটি চম্পা বতী....

কোথায় থেকে যেন অদৃশ্য গানের সুর এবং বাদ্যযন্ত্রের বাজনা আসছে তা কেউ টাহর করতে পারল নাতবে মানুষ বলাবলি করছে- এ গানতো বৃষ্টিই গাইছে;  তবে বাজনা কে বাজাচ্ছেএবার কেউ কেউ বলছে আমরা গান হুনতে আইছি, কে বাজনা বাজাইতাছে বাজাক, আমরার নাইচ গান ভাল লাগদাছেবাজনার খোঁজ নেওয়া আমরার প্রয়োজন নাইকেউ বলছে--- খাইয়াল্লোরে ভাই ! খাইয়াল্লো!

এতো সুন্দর সুরে গানের সঙ্গে নাচ জীবনেও দেখিনি-শুনেনি আমাদের বাপ দাদা চৌদ্দগোষ্টিও এমন আচানক গান শুনে নাইএক লোক বলল ঢাকার বাবু একটা মাইয়া বানাইছে! নাচ শেষ হল
এবার মন্টিকে টান দিয়ে বৃষ্টি নিজের কাছে নিয়ে এল মন্টিকে ইশারায় গাইতে বলে- দুজনই শরু করল -
হার জি চিরদিন থাকবে...... এক পর্যায়ে বৃষ্টি থেমে গেলমন্টির গলার সুর পরিবর্তন হয়ে গেলবৃষ্টি খালামনিকে নিষেধ করল মন্টিকে না ছুঁতেকিন্তু খালামনি মন্টিকে দৌড়ে এসে স্পর্শ করায় মন্টির গলার সুর আবার বে-সুর হয়ে গেলএক পর্যায়ে খালামনি হাত তালি দিতেই- কয়েকজন বেদে দশবারোটি নানান জাতের জাতি সাপ এনে বৃষ্টির শরীরে এনে ঢিল ছুঁড়ে মারলসাপগুলো বৃষ্টির শরীর থেকে নেমে মন্টিকে ছোবল মারলমন্টি সাথে সাথে মাটিতে পড়ে গেলদ্রুত নৌকা নিয়ে মন্টিকে মোহনগঞ্জ হাসপাতালে ভর্তি করা হলডাক্তার বলল- মন্টি আর বেচে নেই
খালামনিকে তিরস্কার করে সব মানুষ চলে গেলকয়েক দিন পরের কথাবিশাল বর্ষণ শুরু হয়েছে, সেই সংগে বাতাসহাওরে সমুদ্রের মতো ঢেউ   উঠল
নানার বাড়ির কাজের মেয়ে মর্জিনা মৃত্যু শয্যায়গরীব মানুষ টাকার অভাবে ঠিকমত চিকিসা করতে পারছে নাসে স্বপ্নে দেখছে- বৃষ্টি এসে মাথায় হাত ভুলালেই ভালে হয়ে যাবেএলাকার সব মানুষ মাকে বুঝানোর চেষ্টা করছে; কিন্তু মার একটাই জবাব আবহাওয়া ভালো হোক তারপর যাওয়া যাবেকারন মর্জিনার বাড়ী বিশাল হাওরের  ও পারেকিন্তু সবার অনুরোধ এবং বৃষ্টির প্রবল ইচ্ছায় শেষ পর্যন্ত যেতেই হল
আসার সময় বিশাল ঢেউ উঠলবৃষ্টিকে কখনো পুরুষ গলার গান গাইতে শুনিনিসে খালি গলায় গাইল।- আমি বৃষ্টির কাছে কাঁদতে শিখেছি,
আমায় কান্নার ভয় দেখিয়ে কোন লাভ নেই
প্রকৃতি যেন কেমন হলে উঠলটেকনাফ থেকে তেতুঁলিয়া ঘুরেছি এমন প্রকৃতির রূপ আমি কখনো কোনদিন কোথাও দেখিনিসে কি যে মিষ্টি সুরতাহলে এ সুর কোথা থেকে আসল! এমনি সময় খালামনি হঠা করে বৃষ্টিকে ধাক্কা মেরে পানিতে ফেলে দিলমা চিকার দিয়ে উঠল - ছোট তুই এ কী করলে? মার স্মৃতি শক্তি চিরদিনের জন্য লোপ ফেলখালামনি নৌকা থেকে মাটিতে পা দেবার সাথে সাথে সাপের ছোবলে মারা গেলএর পরের বছর খবর এলো মর্জিনার একটি মেয়ে সন্তান হয়েছে  দেখতে ঠিক বৃষ্টির মতএ খবর হাওরের এ গ্রাম থেকে ও গ্রামে  কিংবদন্তীর ন্যায় ছড়িয়ে পড়ল

আমার কথা শেষ হতেই ডক্টর পাশ বলেন হ্যাঁ তোমার মাকে সুস্থ করা যাবে? তুমি মর্জিনার মেয়েকে  এক সপ্তাহের মধ্যে আমার কাছে নিয়ে আসতে পারবে তো? মনে রেখো আজীবনের জন্য নিয়ে আসতে হবেমর্জিনা কী তার সন্তান দিবে? আমি বললাম- মর্জিনা আর তার স্বামী আম্মুর জন্য জীবন পর্যন্ত দিতে প্রস্তুতডক্টর বললেন- ছয় বছর আমার কাছে রাখবকাউন্সিলিং করবোছয় বছর পর তোমাদের কাছে নিয়ে আসবতোমরা কখনো আর হাওরে যাবে নাওকে বৃষ্টিই ডাকবেকোন গান শিখানো যাবে নাসাপ টাপ দেখানো যাবে না
চার বছর পরের ঘটনা আমি টেবিলে বসে গান শুনছি- আগুন জ্বলে রে নিভানোর মানুষ নাই-----
হঠা আমার শরীরে নরম হাতের স্পর্শ অনুভব করিচেয়ে দেখি আম্মু সহ বৃষ্টি হাসছে

আবুল কাইয়ূম আহম্মদ
পেশা-শিক্ষক
মোবাইল : ০১৭১৬৩৪৯৭২৪

No comments: