
গেলেন।
আমি বৃষ্টি সম্পর্কে বলা শুরু করলাম :-
আমি তখন এম.এ শেষ পর্ব পরীক্ষা দিয়েছি। ওই অবসরে ক্যাসেট প্লেয়ারে
গান শোনা, বই পড়া ছিল আমার নিত্যদিনের কাজ। একদিন প্রচন্ড বৃষ্টি হচ্ছে, তখন সন্ধ্যা ঘনিয়ে
এসেছে। আব্বু অফিস থেকে ফেরেনি। আম্মু রান্না ঘরে কাজ
করছেন। আমি আমার পড়ার টেবিলে বসে ভিক্টর হুগোর বই পড়ছি আর রবীন্দ্র সংগীত শুনছি।
‘‘পাগলা হাওয়ার বাদল-দিনে
পাগল আমার মন জেগে ওঠে”॥
হঠাৎ আমার পিছন দিকে একটা নরম হাতের স্পর্শ অনুভব করি। সে আর কেউ নয়,
আমার ছোটবোন বৃষ্টি । বোনটি পড়ে কাস টুতে। ভারি মায়াবি ছোট গোলগাল মুখ। তার চেহারা কথা-বার্তায় স্বতস্ফর্তভাবেই যে কোন মানুষকে অনুপ্রাণিত করত। ওই বয়সে সে সবার মন জয় করেছিল। ও যখন আধো আধো স্বরে
দাদা দাদা বলে ডাকে-তখন মনে হয় এমন মধুর ডাক পৃথিবীতে আর কী আছে? সব কাজ ফেলে ওকে কোলে তোলে নেই, আদর করি। ও যখন বায়না ধরে ‘‘দাদা’’ আমাকে একটা পুতুল এনে
দাও না।” আমি আর থাকতে পারি না। দৌড়ে গিয়ে দোকান থেকে বেছে বেছে সবচেয়ে সুন্দর পুতুলটা ওর জন্য কিনে আনতাম। আব্বু যখন বাড়িতে থাকতেন, তখনও আব্বুর কোলে বসে
নানা প্রশ্ন করে আব্বুকে একেবারে অতিষ্ঠ করে তুলতো। ওর দার্শনিক কথায় আমরা অবাক হতাম। ও একবার মুখে যা বলতো, তাই ঘটে যেত। ওর জন্য সবারই কেমন
যেন একটা আলদা দরদ ছিল। ‘একদিন ছুটি হবে, অনেক দূরে যাব, নীল আকাশের সবুজ ঘাসে
খুশিতে হারাব’
‘আগুন জলেরে, নিভানোর মানুষ নাই’ এ ধরনের গান গুণ গুণ
করে গাইত। ওর গানের সুর যে কোন মানুষকে ভাবিয়ে দিত। ঢাকায় কয়েকটা অনুষ্ঠানে গান গেয়েছিল, কিন্তু মানুষের সীমাহীন যন্ত্রনায় আম্মু কোন অনুষ্ঠানে আর বৃষ্টিকে অংশগ্রহণ করতে
দেয়নি।
আমাদের নানা বাড়ি হাওর এলাকায়। বৃষ্টি কখনো হাওর দেখেনি। বর্ষায় হাওর সাগরের মতো রূপ ধারণ করে এটা বৃষ্টি বিশ্বাস করে না। তার কথা হল না দেখে কোনো কিছু বিশ্বাস করতে নেই। বাবাকে বারবার আবদার করেছে নানা বাড়ী যেয়ে
সে হাওর দেখবে। অফিসের নানান কাজে ব্যস্ত থাকায় বাবা এতদিন যেতে পারিনি। এবার যাবেন। আষাঢ়ের ৩০ তারিখ যাবার দিন নির্ধারণ করা হয়েছ। বৃষ্টির সে যে কী আনন্দ! কবে সেই কাঙ্খিত ৩০ তারিখ আসবে? সেই কাঙ্খিত ৩০ এল। আমাদের এক ছোট্ট খালা
আছে। তিনি একটা বে-সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক। খালার একটা মেয়ে ৫ম শ্রেণীতে পড়তো। বৃষ্টির চেয়েও সে তিন
বছরের বড়। তার নাম ছিল মন্টি। কিন্তু আমি ডাকতাম
বকবকি। কারণ ও যখন কথা বলতো
তখন আর তামতো না। ছোট খালা ছিল ভীষণ হিংসুটে। খালার স্বভাব পেয়েছিল মন্টি। আমাদের বাসায় বেড়াতে
এলেই ও বৃষ্টিকে বিনা কারণে মারতো। বৃষ্টি কাউকে কখনো
বিচারও দিতো না। আমি যখন মাঝে মাঝে দেখে ফেলতাম-তখন মন্টিকে ভীষন ধমক দিতাম। মন্টি তা বাড়িয়ে খালামনিকে বলতো। তাই খালামনি আমাকে
পছন্দ করতেন না।
আমরা যাত্রা করলাম মোহনগঞ্জের উদ্দেশ্যে। যাত্রা পথে বৃষ্টির নানান প্রশ্ন? এ জায়গাটার নাম কী? জায়গাটার নাম এমন হল
কেন? অন্যরকম হলনা কেন? ইত্যাদি ইত্যাদি। হাওর আর কত দূর? হাওর এখনো আসছে না কেন?
নেত্রকোণা শহর দেখে বৃষ্টি মুগ্ধ হতে পারেনি। ঢাকার সাথে নেত্রকোণার কোন ভাবেই মেলে না। তারপরও নেত্রকোণা শহর খোলামেলা। প্রচুর গাছপালা আছে
এখানে প্রাণ খুলে শ্বাস নেওয়া যায়। ওই দিকটাই বৃষ্টির
পছন্দ হয়েছে। তার ভাব দেখে তাই মনে হল।
সাপমারা খালের শেষ মোহনায় একটু এগোতেই ডিঙ্গাউতার ওপারের গ্রামগুলো পানির ওপরে
ভেসে উঠলো। গ্রামগুলো যেন টিক ছবির মতো। বৃষ্টি বলেই ফেলল- আম্বু তাহলে এটাই হাওর ! বৃষ্টি আরেক ভাবনার জগতে পড়ে যায়। দূর থেকে ইঞ্জিল চালিত নৌকার শব্দ ভেসে আসছে। এদিক ও দিক তাকালেই দেখা যায় ছোট ছোট নৌকা। বৃষ্টি আবারও বলল, আম্মু ছোট ছোট নৌকায় মানুষেরা কী করছে? ওদের নৌকা ডুবছেনা কেন? গ্রামগুলো পানির ওপরে ভাসছে কেন? ডিঙ্গাউতা নামটি কেমন করে হল? আর বিশাল হাওর দেখে
তো বৃষ্টি আবেগে আপ্লুত হয়ে গেল। আমরা নানা বাড়ি এসে যখন পৌছেছি, তখন চারদিক থেকে মানুষ
এক নজর বৃষ্টিকে দেখার জন্য ভিড় করছে।
ছোট ছোট ছেলে মেয়ের বাজার জমে গেল। কোনটা ল্যাংটা, কোনটার হাফ-প্যান্ট ছেঁড়া, কোনটার ফ্রক ময়লা, নোংরা, কোনটার নাকে ছিদ্র পথে সিঙ্গাইল বেরিয়ে আছে, কোনটার চোখের কোনে ময়লা। কোনটা খিল খিল করে হাসে, পরস্পরের মধ্যে দুষ্টুমিও
করে। এগুলো দেখে বৃষ্টি একেবারে নীরব হয়ে গেল। খালামনি ওদের কড়া ভাষায় শাসিয়ে দিল। মন্টি অকথ্য ভাষায়
গালি গালাজ করতে থাকলো। আব্বু তাদের ধমক দিয়ে থামিয়ে দিল।
মা রাগ করে এক পর্যায়ে বলল- আমারা অনেক দূর থেকে এসেছি। আমরা কান্ত,
আপনারা এখন চলে যান। আমরাই আপনাদের সবার বাড়িতে বেড়াব। বৃষ্টি মার কথা টেনে
নিয়ে বলল কারো বাড়িতে কেউ আসলে তাকে এভাবে তাড়িয়ে দিতে নেই। এ কথা শোনে সবাই কিছুনের জন্য নির্বাক
দাঁড়িয়ে বৃষ্টিকে দেখতে লাগল। এমন সময মামা ডাকলেন-
ওই মর্জিনা শরবত নিয়ে আয়। সঙ্গে সঙ্গে দৌড়ে একটা মেয়ে ঝগ ভড়ে শরবত নিয়ে এল। তার চেহারা দেখে মনে হলনা সে কাজের মেয়ে। বয়স ১৭-১৮ হবে।
হাওরের দশবারোটি বাড়ি। আবার কখনো পনের বিশটা
বাড়ি নিয়ে একটা পাড়া গঠিত হয়। পাড়াগুলোকে আঁটি বলে। যেমন পশ্চিম আটি, পূর্ব আঁটি। বর্ষকালে প্রতিটা আঁটিই পানি দ্বারা বেষ্টিত থাকে। আমরা পরের দিন ডিঙ্গি নৌকা নিয়ে আঁটি দেখতে বের হই। সঙ্গে তো মর্জিনা আছেই। মর্জিনায় বৃষ্টিকে
দেখিয়ে দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। আমরা যখন বের হই তখন
ছোট বড় ছেলেমেয়ের দল এসে আমাদের সঙ্গে যোগ দেওয়ায় দলটা আরো বৃদ্ধি পেতে থাকল। কারো ঘরেই কোন ভাল খাট নেই, বিছানা নেই, কোন সোফা নেই, কোনো ফর্নিচার নেই। বাড়ির বেড়া অনেকটা ভাঙ্গা। বোড়ার ফাঁক দিয়ে হাওরের পানি দেখা যায়। কেউ ভাত খাচ্ছে, শোকনা মাছের গুড়া, ছেপা শুটকি মিশিয়ে, খুব কম বাড়িতেই দেখা
গেল মাছ দিয়ে ভাত খেতে। একটা বিষয় বৃষ্টি বুঝতে পারে এদের বাহিরটা যত নোংরা হোক, ভেতরটা বড় পরিস্কার। কত কষ্ট তাদের! তারপরও
ওরা মনের আনন্দে গান গায়। মর্জিনা হঠাৎ একটা মহিলাকে পরিচয়
করিয়ে বলে- বৃষ্টি আপু ও আমার সই। ভাল গান গাইতে পারে। সই বৃষ্টিকে একটা গান শোনাও। আর ওদিকে একটা বয়স্ক
মহিলা আমাদের একটা শীতপাটি এনে দিল। আমরা সবাই বসলাম। তিনি শুরু করলেন ‘সোনার ময়না পাখিরে
আমার’ ওই গান শুনেতো বৃষ্টি বিশ্বাসই করতে পারছে না। এত সুন্দুর স্বরে হাওরে কেউ গান গাইতে পারে? গান শেষ হলে এই প্রথম বৃষ্টির মুখে শুনলাম আরেকটা গান গাইবেন? উনি বৃষ্টিকে ‘আপু’ বলে আবার গাইলেন?--- ‘মনের দুঃখ কইতাম রে বন্ধু, রাইখাছি অন্তরে’।
গানটা শেষ হওয়া মাত্রই খালামনি বলে উঠলেন- আমার মেয়ে মন্টি ভালো গান গাইতে পারে। আপনারা শুনবেন! সবাই বলল- হ্যা।
মন্টি শুরু করল- ‘মন মেতেছে মন ময়ূরীর
মন ময়ূরীর কী খেলা, নাম না জানা ফুল ফুঠানোর
এই বেলা’---।
বেসুরে গান গাওয়ায় কেউ হাততালি না দেওয়ায় ছোট খালা এক পর্যায়ে বলে ফেলল- ওই ছোটলোকের
বাচ্চারা তোরা হাত তালি দিলে না কেন? তোরা কি বোঝবে ওই গানের অর্থ? তোরা হলি ভাইট্যা গাবর, তোরা সোনার ময়না পাখিই বুঝবে। এ কথা শুনে মর্জিনার সই তীব্র প্রতিবাদ করে বলেন- ছোট ফুফু আপনিও কিন্তু ভাইট্যা। এক পর্যায়ে ভীষণ ঝগড়া শুরু হল। যতই আপন হোক নিজের
জন্ম ভূমিকে কেউ কটা করে কথা বললে কেউ সহ্য করতে পারে না। বৃষ্টি এক পর্যায়ে বলে উঠে-খালামনি তুমি কিন্তু দুটো গানকেই অবমূল্যায়ন করেছ। তুমি একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক। সুধীন দাস গুপ্ত এবং
হাসন রাজাকে এভাবে অপমান করা তোমার ঠিক হয়নি। তুমি মা চাও! নয়তো তোমার বিপদ ঘটবে। খালামিন উচ্চস্বরে
হেসে হেসে আবার বলেন- আমার বিপদ ঘটবে ! কী
বলিস বৃষ্টি? এই বলে খালা নানা বাড়ি
চলে যায়।
মর্জিনার সই বৃষ্টিকে এবার বললেন- ‘শিল্লুক’ শুনবে বৃষ্টি আপু। শিল্লুক কি? তিনি বলেন এক প দুই চারটা ছড়ার লাইন বলবে, অন্য প সেই ছড়ার অর্থ বলে দেবে, এটাই শিল্লুক। বৃষ্টি মহা আনন্দে
বলে উঠে বলুন বলুন। মর্জিনা সই বলেন ঘর আছে দোয়ার নাই, মানুষ আছে রাও নাই, মর্জিনা বলে এটা ‘কবর’। এবার মর্জিনা বলল- জঙ্গল থাইকা আইল বুড়ি, চোখ তার আঠার কুড়ি। তিনি উত্তর দিলেন-‘আনারস’ পাশে বসে আম্মু খুব উপভোগ করছিল। এ ভাবে অনেকন শিল্লুক চলছিল।
বাড়িতে এসে বৃষ্টির কত যে প্রশ্ন?। ওই ছেলে মেয়েগুলোর
কাপড় নেই কেন?
ওদের সবাইকে তো মাছ মারতে দেখেছি, তবে কেন ওরা মাছ খায় না? ওদের অনেকের ঘর ভাঙ্গা কেন? খালার এমন ব্যবহারে
পুরো গ্রামের মানুষের হৃদয়ে আঘাত করল। সব মানুষ খালাকে ছিঃ
ছিঃ দিতে থাকল।
একদিন কাক-ডাকা ভোরে ছোট খালার চেঁচামেচিতে ঘুম ভেঙ্গে যায়। তিনি হাউমাউ করে কাঁদেতে লাগলেন। আম্মু বলেন- ছোট তোর
কী হয়েছে- বলতো। খালা মনি উত্তেজিত স্বরে বলেন তোমাকে বলে কিছু লাভ হবে না, তুমি আমার সামনে থেকে চলে যাও। মামা এক পর্যায়ে খালামনি কে বলেন- তোর কি হয়েছে বল? খালা এবার চোখের জল মুছতে মুছতে বলেন- আমার সব গয়না চুরি হয়েছে। মামা উত্তেজিত হয়ে বলেন- কি করে হল। খালামনি তার ল্যাগেজ
এনে দেখালো ওই দেখ কিভাবে ভেঙ্গে স্বর্ণগুলো নিয়ে গেছে? চোর ঘরেই আছে। আমার একশতভাগ বিশ্বাস মর্জিনাই গয়নাগুলো নিয়েছে। মামা কিছুতেই বিশ্বাস করতে চান না। খালামনির গলর স্বর
ক্রমেই বাড়তে থাকলো। তিনি গলা ফাটিয়ে বলেন- মর্জিনা কোথায় গেছে খুঁজে বের করুন। যেহেতু মর্জিনা বাড়িতে নেই, তাই মর্জিনাই আমার
গয়নাগুলো নিয়ে পালিয়েছে। মামা এবার খালামনিকে উদ্দেশ্য করে বলেন, তুই বাড়ীতে এলেই সমস্যার
সৃষ্টি করিস, মর্জিনা কাজের মেয়ে হতে পারে, তবে ও চোর নয়, তুই জানিস না, ওর কাছে এখনো দুই ল টাকা জমা আছে। কারন এই হাওর এলাকায় কখন টাকার দরকার হয় কেউ জানেনা। ব্যাংকে যেয়ে টাকা তোলে বাড়ী আসতে আসতে রাত হয়ে যায়। ও এমন বিশ্বস্থ যে, যে ভাবে টাকার নোটগুলো
জমা রাখা হয়, সেই ভাবে ফেরত পাওয়া যায়।
এরই মাধ্যে দেখা গেল মর্জিনা তার স্বামীকে মামার কাছে ধরে নিয়ে এসে বলে- ওই চোরটা
ছোট খালার স্বর্ণ চুরি করেছে। ওকে বাধুন। তারপর মামার হাতে গয়না তুলে দেন। মামা খালামনিকে গয়না
বুঝিয়ে দিয়ে বলেন এবার কান্না বন্ধ কর । ছোট খালামনি কান্না
বন্ধ না করে হাতে লাঠি নিয়ে শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে মর্জিনা ও তার স্বামীকে পেটাতে
থাকে। মামা অনেক চেষ্টা করেও ফেরাতে পারছে না। ওদিকে অনেক মানুষের ভীর জমে গেছে। বৃষ্টি হঠাৎ করে খালামনির পা ধরে অশ্র“জলে বলে- খালামনি ওদের
আর মেরো না। ওরা যে মরে যাবে। তখন একটা আশ্চর্য ঘটনা
ঘটল কোথায় থেকে যেন গোখরা সাপ এসে খালামনিকে ঘিরে ধরল। খালামনি তো চিৎকার! সাপ! সাপ! ভয়ে খালামনি কাঁপতে লাগল এবং হাত থেকে লাঠি পড়ে
গেল। মামা সেই লাঠি তুলে নিল। সঙ্গে সঙ্গে চল্লিশ পঞ্চাশ জন লোক দেশিয় অস্ত্রসহ সাপগুলোকে মারবার জন্য মামার
সঙ্গে যোগ দিল। বৃষ্টি সাপগুলোকে মারতে নিষেধ করল। তারপরও যখন নিষেধ মানছে না তখন বৃষ্টি সাপগুলোকে ধরে পাহারা দিতে থাকে। চারদিকে চিৎকার- বৃষ্টিকে সাপগুলো
ছোবল দিচ্ছে। আম্মু কোথায় থেকে যেন দৌড়ে এসে বৃষ্টিকে কোলে তোলে নিল এবং কোন
সাপ দেখতে না পেয়ে আমাকে বলল- তুইও মিথ্যা শিখে ফেলছিস!
মামা বলল- সত্যি সাপ ছিল। সবাইকে জিজ্ঞাসা কর
তাছাড়া নির্জরও তো দেখেছে।
আম্মু বৃষ্টিকে চুমু দিয়ে আদর করতে করতে বুকের সাথে মিশিয়ে বলেন- মারে তুই এসব
কী শুরু করছিস। তোকে নিয়ে আমার ভয়টা দিন দিনই বাড়ছে। আব্বু তখন কোথায় যেন চলে গিয়েছিল। হঠাৎ আব্বু এসে বলেন কী যেন ঘটেছে। আম্মু রাগের স্বরে
বলেন- তুমি ত মেয়ের খবর রাখ না? নৌকা ঠিক কর, আমরা আজই ঢাকা চলে যাব। মামা সহ আশে পাশের সবাই মাকে বুঝিয়ে থামাল। ওদিকে খালামনির অমানবিক নির্যাতনে মর্জিনা
ও তার স্বামীর অবস্থা সংকট জনক। স্থানীয় এক ডাক্তারকে
নিয়ে আসা হল। তিনি কিছু ঔষধপত্র লিখে দিলেন এবং রোগীদের মোহনগঞ্জ কিংবা নেত্রকোণা
দ্রুত পাঠাতে নির্দেশ দিলেন। আব্বু, মামা নৌকা ভাড়া করে রোগীদের নিয়ে মোহনগঞ্জ চলে যায়।
মনটা আমার ভাল যাচ্ছিলনা, তাই নানাবাড়ি থেকে একটু দূরে একটা নদীর ধারে পাকা বেদির উপর বসে এসব ঘটনা নিয়ে ভাবছি। দূর থেকে বিশাল বিশাল ঢেউ এসে বেদির ওপর আঁচড়ে পড়ছে। এমন সময় অনেক গুলো
বেদের বহর দেখতে পেলাম। নৌকাগুলো দেখে মনটা কেমন জানি ধক করে উঠল।
তিনদিন পর মর্জিনা এবং তার স্বামীকে সুস্থ
করে মামা নিয়ে আসলেন। মর্জিনা আর নানার বাড়ি থাকলো না। যাবার সময় মর্জিনা কি যে কান্না তা প্রকাশ করার মত নয় ! আম্মু – মামার শত অনুরোধ স্বত্তেও সে নিজ বাড়িত চলে যায়। আব্বা ঢাকা চলে গেলেন। আম্মুকে মামা একটা চিঠি দিলেন চিঠিতে লেখা তুমি বৃষ্টি এবং নির্ঝরকে কাছে কাছে
রাখবে। আমি তিনদিনের ভেতর আসছি। তুমি কোন চিন্তা করবে না।
পরের দিন বেদের দল মামার বাড়ি সাপ খেলা দেখাবে। প্রায় পুরো গ্রামের মানুষ মামার বাড়ি দখল করে নিয়েছে। এরই মাঝে খালামনিকে কয়েকজন বেদের সঙ্গে ফিসফিসানো কথা বলতে দেখলাম। সাপের খেলা শুরু হল। গ্রামের সবার আবদার তারা বৃষ্টির নাচ ও গান শুনবে। মন্টির গান শুনবে না কারণ মন্টি বেসুরে গান গায়। আম্মু কিছুতেই বৃষ্টিকে গান গাইতে দেবে না। গ্রামের সবার কথায় আম্মু রাজি হলেন। বৃষ্টি নাচ শুরু করল-
‘বাবু সেলাম বারে বার
আমার নামটি চম্পা বতী....’
কোথায় থেকে যেন অদৃশ্য গানের সুর এবং বাদ্যযন্ত্রের বাজনা আসছে তা কেউ টাহর করতে
পারল না। তবে মানুষ বলাবলি করছে- এ গানতো বৃষ্টিই গাইছে; তবে বাজনা কে বাজাচ্ছে। এবার কেউ কেউ বলছে
আমরা গান হুনতে আইছি, কে বাজনা বাজাইতাছে
বাজাক, আমরার নাইচ গান ভাল লাগদাছে। বাজনার খোঁজ নেওয়া আমরার প্রয়োজন নাই। কেউ বলছে--- খাইয়াল্লোরে
ভাই ! খাইয়াল্লো!
এতো সুন্দর সুরে গানের সঙ্গে নাচ জীবনেও দেখিনি-শুনেনি আমাদের বাপ দাদা চৌদ্দগোষ্টিও
এমন আচানক গান শুনে নাই। এক লোক বলল ঢাকার বাবু একটা মাইয়া বানাইছে! নাচ শেষ হল।
এবার মন্টিকে টান দিয়ে বৃষ্টি নিজের কাছে নিয়ে এল মন্টিকে ইশারায় গাইতে বলে- দুজনই
শরু করল -
হার জিৎ চিরদিন থাকবে...... । এক পর্যায়ে বৃষ্টি থেমে গেল। মন্টির গলার সুর পরিবর্তন
হয়ে গেল। বৃষ্টি খালামনিকে নিষেধ করল মন্টিকে না ছুঁতে। কিন্তু খালামনি মন্টিকে দৌড়ে এসে স্পর্শ করায় মন্টির গলার সুর আবার বে-সুর হয়ে
গেল। এক পর্যায়ে খালামনি হাত তালি দিতেই- কয়েকজন বেদে দশবারোটি নানান
জাতের জাতি সাপ এনে বৃষ্টির শরীরে এনে ঢিল ছুঁড়ে মারল। সাপগুলো বৃষ্টির শরীর থেকে নেমে মন্টিকে ছোবল মারল। মন্টি সাথে সাথে মাটিতে পড়ে গেল। দ্রুত নৌকা নিয়ে মন্টিকে
মোহনগঞ্জ হাসপাতালে ভর্তি করা হল। ডাক্তার বলল- মন্টি
আর বেচে নেই।
খালামনিকে তিরস্কার করে সব মানুষ চলে গেল। কয়েক দিন পরের কথা। বিশাল বর্ষণ শুরু হয়েছে, সেই সংগে বাতাস। হাওরে সমুদ্রের মতো ঢেউ
উঠল।
নানার বাড়ির কাজের মেয়ে মর্জিনা মৃত্যু শয্যায়। গরীব মানুষ টাকার অভাবে ঠিকমত চিকিৎসা করতে পারছে
না। সে স্বপ্নে দেখছে- বৃষ্টি এসে মাথায় হাত ভুলালেই ভালে হয়ে যাবে। এলাকার সব মানুষ মাকে বুঝানোর চেষ্টা করছে; কিন্তু মার একটাই জবাব আবহাওয়া ভালো হোক তারপর যাওয়া যাবে। কারন মর্জিনার বাড়ী বিশাল হাওরের ও পারে। কিন্তু সবার অনুরোধ এবং বৃষ্টির প্রবল ইচ্ছায় শেষ পর্যন্ত যেতেই হল।
আসার সময় বিশাল ঢেউ উঠল। বৃষ্টিকে কখনো পুরুষ
গলার গান গাইতে শুনিনি। সে খালি গলায় গাইল।- “আমি বৃষ্টির কাছে কাঁদতে শিখেছি,
আমায় কান্নার ভয় দেখিয়ে কোন লাভ নেই”।
প্রকৃতি যেন কেমন হলে উঠল। টেকনাফ থেকে তেতুঁলিয়া ঘুরেছি এমন প্রকৃতির রূপ আমি কখনো কোনদিন কোথাও দেখিনি। সে কি যে মিষ্টি সুর। তাহলে এ সুর কোথা থেকে আসল! এমনি সময় খালামনি হঠাৎ করে বৃষ্টিকে ধাক্কা মেরে পানিতে ফেলে দিল। মা চিৎকার দিয়ে উঠল - ছোট তুই এ কী করলে? মার স্মৃতি শক্তি চিরদিনের জন্য লোপ ফেল। খালামনি নৌকা থেকে মাটিতে পা দেবার সাথে সাথে সাপের ছোবলে মারা গেল। এর পরের বছর খবর এলো মর্জিনার একটি মেয়ে সন্তান হয়েছে। দেখতে ঠিক বৃষ্টির মত। এ খবর হাওরের এ গ্রাম থেকে ও গ্রামে কিংবদন্তীর
ন্যায় ছড়িয়ে পড়ল।
আমার কথা শেষ হতেই ডক্টর পাশ বলেন হ্যাঁ তোমার মাকে সুস্থ করা
যাবে? তুমি মর্জিনার মেয়েকে
এক সপ্তাহের মধ্যে আমার কাছে নিয়ে আসতে পারবে তো? মনে রেখো আজীবনের জন্য নিয়ে আসতে হবে। মর্জিনা কী তার সন্তান দিবে? আমি বললাম- মর্জিনা
আর তার স্বামী আম্মুর জন্য জীবন পর্যন্ত দিতে প্রস্তুত। ডক্টর বললেন- ছয় বছর আমার কাছে রাখব। কাউন্সিলিং করবো। ছয় বছর পর তোমাদের কাছে নিয়ে আসব। তোমরা কখনো আর হাওরে
যাবে না। ওকে বৃষ্টিই ডাকবে। কোন গান শিখানো যাবে
না। সাপ টাপ দেখানো যাবে না।
চার বছর পরের ঘটনা আমি টেবিলে বসে গান শুনছি- আগুন জ্বলে রে নিভানোর মানুষ নাই-----
হঠাৎ আমার শরীরে নরম হাতের স্পর্শ অনুভব করি। চেয়ে দেখি আম্মু সহ বৃষ্টি হাসছে।
আবুল কাইয়ূম আহম্মদ
পেশা-শিক্ষক
মোবাইল : ০১৭১৬৩৪৯৭২৪
No comments:
Post a Comment